ময়মনসিংহ: শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ইং (চেতনা ২৪ নিউজ) ১৯৫২ সালের এক উত্তাল দিন ২১ ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার রাজপথ ছিল প্রতিবাদের উত্তাল। বাংলার দামাল ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। তাদেরই একজন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর গর্বিত সদস্য, ভাষা শহিদ ও আনসার প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল জব্বার। সকলের ন্যায় তার হৃদয়েও জ্বলছিল দেশপ্রেমের অগ্নিশিখা। তার মননে, চিন্তা, চেতনায় ছিলো বাংলার মাটি, মাতৃভাষা, মানুষের অধিকার। তাই ভাষা আন্দোলনের সেই সংকটময় সময়ে তিনি আর স্থির থাকতে পারেননি। মাতৃভাষার দাবীতে রাজপথে নেমে এলেন ছাত্র-জনতার সাথে।
১৯৪৯ সালে তিনি আনসার বাহিনীতে যোগদান করেন।পরবর্তীতে ১৯৫১ ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজ মাঠে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর আনসার বাহিনীতে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে যোগদান করেন ময়মনসিংহ জেলাধীন গফরগাঁও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামের যুবক আব্দুল জব্বার। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকায় মিছিল বের করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে পৌঁছালে আনসার প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল জব্বার মিছিলে যোগদান করেন। পুলিশ সমাবেত ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য অতর্কিত গুলি ছুঁড়তে থাকে। পুলিশের গুলি যখন মিছিলের দিকে ধেয়ে আসছিল, আব্দুল জব্বার পিছু হটেনি। জীবনের মায়া ত্যাগ করে ভাষার তরে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে এসে অন্যদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। হটাৎ ঘাতকের বুলেটে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ভাষা শহিদ আব্দুল জব্বার। তার শরীর থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত মিশে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাজপথে। সেই রক্ত শুধু রাজপথকে রাঙায়নি, বাঙালির হৃদয়কে জাগিয়ে তুলেছিলো।
আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য হিসেবে আব্দুল জব্বারের আত্মত্যাগ ছিল নিঃস্বার্থ। তিনি ছিলেন এক অকুতোভয় যোদ্ধা। যিনি নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছেন কোটি বাঙ্গালীর হৃদয়ে। আজও প্রতিটি আনসার সদস্য ভাষা শহিদ ও প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল জব্বারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ ও জনগণের কল্যানে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের যেকোন সংকটকালীন মুহূর্তে এবাহিনীর ৬০ (ষাট) লক্ষাধিক সদস্য ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের আদর্শ ও চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব, নৈতিকতা ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করে।
ভাষা শহীদ প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল জব্বারের স্মরণে ১৯৮৫ সালে আনসার ও ভিডিপি একাডেমি, সফিপুর, গাজিপুরে ‘ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার আনসার ভিডিপি স্কুল এন্ড কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, দেশে ভাষা শহিদের নামে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এটি। এছাড়াও আনসার ভিডিপি একাডেমিতে বীর আনসার কমান্ডার ‘ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার’ গ্রন্থাগার স্থাপন করা হয়। তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলায় ২০০৭ সালে ‘ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’ ও শহীদ জব্বার বেসরকারি রেজিস্টার প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের উদ্যোগে ‘ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার মিলনায়তন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সাথে তার গ্রামের বাড়িতে ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার ফাউন্ডেশনসহ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে ‘ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার স্মৃতি স্কুল এন্ড কলেজ’ ও তার নামে জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলন ও তার নানা অনুষঙ্গ নিয়ে অজস্র গান, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটক রচিত হয়েছে। অঙ্কিত হয়েছে শিল্প-সুষমামণ্ডিত বহু চিত্রকর্ম।
ভাষা আন্দোলনে আত্মোৎসর্গকারী আনসার প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল জব্বারের অবদান অনস্বীকার্য। ভাষা আন্দোলনে তার মহান আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক “মরণোত্তর একুশে পদক” এ ভূষিত করা হয়। ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের আত্মত্যাগ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মাতৃভাষার জন্য লড়াই ও ত্যাগের গল্প। তার মত অকুতোভয় বীরের কারণেই আজ আমরা গর্বের সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষ হতে এই মহান বীর ও ভাষা শহিদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
সূত্র:-চে/২৪/নি
মন্তব্য করুন